বৎস! সম্মুখে স্নিগ্ধ আলো বিকশিত। সে আলোতে সুপ্রশস্ত অনেক পথ দেখিতে পাইতেছি, সুতরাং আমার ও আমার বলিতে যারা আছে, তাদের আর জড়তার সময় নাই- সম্মুখে অসংখ্য কাজ। প্রতি ভাইকে হাতে ধরিয়া, কাঁধে করিয়া মায়ের কোলে তুলিয়া দিতে হইবে। রজোগুণের ধ্বংসে পৃথিবীব্যাপী সাত্ত্বিক গুণের বিকাশ অবশ্যম্ভাবী। মহাযুদ্ধের পর ধর্মরাজ্যস্থাপন প্রকৃতির অবশ্যম্ভাবী ফল; শ্রীগুরুর কার্য গুরুতররূপে বর্ধিত হইয়া চলিল। আর অনুতাপ-অনুশোচনার সময় নাই। কেবল মা মা মা রবে মায়ের ছেলের স্বরূপ জানাও।
-শ্রীশ্রী ঠাকুর
বৎস! সম্মুখে স্নিগ্ধ আলো বিকশিত।
এই একটি বাক্যের মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে এক অপার জাগরণবার্তা। আমাদের জীবন যখন অন্ধকার, ক্লান্তি আর জড়তার বেড়াজালে আটকে যায়, তখনই শ্রীগুরুর কৃপায় সামনে ফুটে ওঠে স্নিগ্ধ আলোর পথ। সেই আলো আমাদের দেখিয়ে দেয়—
আমরা একা নই, আমরা অসহায় নই, সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে অসংখ্য কর্মক্ষেত্র, অসংখ্য সেবা সুযোগ, অসংখ্য জাগরণ রেখা।
সুপ্রশস্ত পথের ইঙ্গিত: আর জড়তার সময় নেই
গুরুবাণীতে এসেছে—
“সে আলোতে সুপ্রশস্ত অনেক পথ দেখিতে পাইতেছি, সুতরাং আমার ও আমার বলিতে যারা আছে, তাদের আর জড়তার সময় নাই — সম্মুখে অসংখ্য কাজ।”
এখানে “আমার ও আমার বলিতে যারা আছে” বলতে বোঝানো হয়েছে শিষ্য, ভক্ত, সত্যসন্ধানী সকল মানুষকে। যাদের অন্তরে গুরুতত্ত্বের প্রতি শ্রদ্ধা আছে, তাদের জন্য অলসতা আর অজুহাতের কোনো স্থান নেই।
আজকের এই যুগে, চারদিকে যখন বিভ্রান্তি, অবিচার, অশান্তি আর ভোগবাদ বাড়ছে— তখন সত্যধর্ম, সত্ত্বগুণ, মানবতা ও সেবার পথে এগিয়ে আসাটাই হচ্ছে প্রকৃত সাধনা।
জড়তা মানেই পতন।
কর্ম ও সেবা মানেই উত্থান।
প্রতি ভাইকে হাতে ধরে, কাঁধে করে মায়ের কোলে তোলা
গুরুবাণী বলে—
“প্রতি ভাইকে হাতে ধরিয়া, কাঁধে করিয়া মায়ের কোলে তুলিয়া দিতে হইবে।”
এখানে যে “মা”, তিনি কেবল জাগতিক মা নন; তিনি চিরমাঙ্গলময়ী আদ্যাশক্তি, ভগবতী, পরাশক্তি, দয়াময়ী গুরুমা— যাঁর কোলেই সব প্রাণীর আশ্রয়।
এই বাক্যে তিনটি বড় দায়িত্ব আমাদের সামনে উঠে আসে—
-
প্রতি ভাইকে হাতে ধরা
-
যারা পথ হারিয়েছে, যারা অন্ধকারে আছে, যারা গ্লানি ও হতাশার মধ্যে ডুবে আছে— তাদের পাশে দাঁড়ানো।
-
কেবল উপদেশ নয়, স্নেহ, সহানুভূতি ও সঙ্গ দেওয়া।
-
-
কাঁধে করে তোলা
-
কারও উন্নতি, কারও আধ্যাত্মিক বা নৈতিক জাগরণ একা একা হয় না।
-
কখনও কখনও নিজের স্বাচ্ছন্দ্য, সময়, অর্থ, শক্তি ত্যাগ করে অন্যকে তুলে ধরতে হয়।
-
-
মায়ের কোলে পৌঁছে দেওয়া
-
শেষ আশ্রয় একটাই — ঈশ্বর, গুরু, মা।
-
আমরা কারও উদ্ধারে কেবল মাধ্যম; প্রকৃত শান্তি, প্রকৃত নিরাপত্তা সে পাবে যখন “মায়ের কোল” অর্থাৎ ঈশ্বরীয় স্নেহ-সুরক্ষায় আশ্রিত হবে।
-
রজোগুণের ধ্বংসে সাত্ত্বিক গুণের বিকাশ
“রজোগুণের ধ্বংসে পৃথিবীব্যাপী সাত্ত্বিক গুণের বিকাশ অবশ্যম্ভাবী।”
ত্রিগুণের (সত্ত্ব, রজ, তম) মধ্যে রজোগুণ মানে অস্থিরতা, ভোগলালসা, স্বার্থ, অহং। এই রজোগুণ যখন ধীরে ধীরে কমতে থাকে, তখনই সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি পায়—
-
সত্যকে ভালো লাগতে শুরু করে
-
মিথ্যা, অন্যায়, কপটতা কষ্ট দিতে শুরু করে
-
অন্তরে শান্তি, ভক্তি, দয়া, সেবামন বাড়তে থাকে
আজকের বিশ্বজুড়ে যে অস্থিরতা, যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব চলছে— তা রজোগুণেরই ফল। কিন্তু গুরুবাণী আমাদের আশ্বাস দেয়—
রজো প্রাধান্য যতই তুঙ্গে উঠুক, শেষ কথা বলবে সত্ত্বই।
সত্ত্বের জাগরণ অবশ্যম্ভাবী।
মহাযুদ্ধ ও ধর্মরাজ্য স্থাপনের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা
“মহাযুদ্ধের পর ধর্মরাজ্যস্থাপন প্রকৃতির অবশ্যম্ভাবী ফল; শ্রীগুরুর কার্য গুরুতররূপে বর্ধিত হইয়া চলিল।”
এখানে “মহাযুদ্ধ” শুধু বাহ্যিক যুদ্ধ নয়;
-
মানুষের অন্তরের কাম, ক্রোধ, লোভ, অহংকারের সঙ্গে যুদ্ধও বোঝানো যেতে পারে
-
সমাজে সত্য-অসত্যের সংঘাতও বোঝানো যেতে পারে
যখন এই সংঘাত চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়, তখনই নতুন এক যুগের সূচনা হয়—
-
সত্যের জয় হয়
-
ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়
-
গুরুতত্ত্বের কার্য, অর্থাৎ মানুষকে সৎপথে ফিরিয়ে আনা, আরও দ্রুত ও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হতে থাকে
ধর্মরাজ্য মানে কোনো রাজনৈতিক রাজ্য নয়,
বরং—
-
ন্যায়, প্রেম, সহিষ্ণুতা, ভক্তি, সত্য ও সেবাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানবসমাজ।
অনুতাপ–অনুশোচনার সময় ফুরিয়ে এসেছে
“আর অনুতাপ-অনুশোচনার সময় নাই।”
আমরা প্রায়ই অতীতের ভুল, ব্যর্থতা, পাপ, অভিমান নিয়ে ডুবে থাকি।
কিন্তু গুরু আমাদের ডাকছেন—
-
যা হয়ে গেছে, তা নিয়ে শুধু পুড়ে মরে লাভ নেই
-
এখন প্রয়োজন কর্মে ফেরা, সাধনায় ফেরা, মায়ের কোলের পথে ফেরা
অনুতাপ যদি সত্যি হয়, তার প্রমাণ কাজের মাধ্যমে দিতে হয়—
-
খারাপ অভ্যাস ত্যাগ
-
অন্যের উপকারে লাগা
-
সত্যপথে অবিচল থাকা
-
গুরুর নামে, মায়ের নামে সৎকর্ম শুরু করা
কেবল মা মা মা — মায়ের ছেলের স্বরূপ জানো
শেষে এসেছে এক অপূর্ব ডাক—
“কেবল মা মা মা রবে মায়ের ছেলের স্বরূপ জানাও।”
এখানে দ্বৈত আহ্বান—
-
জপ – “মা মা মা”
-
অন্তরে, মুখে, কাজে, জীবনে সর্বত্র “মা”-কে স্মরণ করা
-
কষ্টে, ভয়েতে, সুখে, আশঙ্কায়, একাকিত্বে— সব সময় “মা”-র শরণ নেওয়া
-
-
জ্ঞান – “মায়ের ছেলের স্বরূপ জানাও”
-
আমি কে? আমি কার?
-
আমি কি শুধু দেহ, নাকি আমি মায়ের সন্তান— চিরসচেতন, চিরস্নেহধন্য আত্মা?
-
এই প্রকৃত স্বরূপ যখন জানা যায়, তখন ভয়, হীনমন্যতা, আসক্তি, অস্থিরতা অনেকটাই কমে যায়
-
“আমি মায়ের ছেলে” – এই বোধটাই আসল শক্তি।
তখন আর নিজেকে একা মনে হয় না, অসহায় মনে হয় না।
উপসংহার
এই গুরুবাণী কেবল সাহিত্য নয়, কেবল ভাবালু বাণীও নয়—
এটি একটি জাগরণ নির্দেশিকা –
-
জড়তা ভাঙার আহ্বান
-
সেবা ও কর্মের অঙ্গীকার
-
রজোগুণের তাণ্ডবের মাঝে সত্ত্বের বিজয়ের আশ্বাস
-
অনুতাপ ছেড়ে কাজে নেমে পড়ার ডাক
-
আর সর্বোপরি—
“মা মা মা” জপের মাধ্যমে নিজের প্রকৃত পরিচয় ফিরে পাওয়ার পথ
যে বৎস এই ডাকে সাড়া দেয়, তার জন্য সামনে সত্যিই “স্নিগ্ধ আলোতে সুপ্রশস্ত অনেক পথ” উন্মুক্ত হয়ে যায়।
